মানবি মস্তিষ্কঃ থ্রি পাউন্ড ইউনিভার্স বা চৌদ্দ শ গ্রাম ভরের মহাবিশ্ব

 IRRSTC 2

মানবি মস্তিষ্কঃ থ্রি পাউন্ড ইউনিভার্স বা চৌদ্দ শ গ্রাম ভরের মহাবিশ্ব

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উদ্ভাবনের দিক বিবেচনা করলে মানুষ এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে মহাবিশ্বের কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্যালাক্সির নক্ষত্রের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে পৃথিবীতে বসে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দিয়েছে স্বয়ংক্রিয় রোবট, ভবিষ্যতের মানুষের জন্য বাসযোগ্য নতুন পৃথিবী খুঁজতে মহাবিশ্বের বিস্ময়কর রহস্যের আবরণ সরাতে শুরু করেছে মানুষ কয়েক বছর আগে থেকেই অথচ মানুষ এখনো নিজের শরীরের সব কটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজকর্ম কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হদিস পায়নি যে মহাবিশ্বে আমাদের বাস, সেই জটিল মহাবিশ্বের মতো জটিলতা রয়েছে আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কে সে কারণেই আমাদের মস্তিষ্ককে বলা হয় থ্রি পাউন্ড ইউনিভার্স বা চৌদ্দ গ্রাম ভরের মহাবিশ্ব

আমাদের শরীর ও মনের সব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্কের গড় ভর এক কেজি চার শ গ্রামের মতো। ছোট্ট একটা ফুলকপির সাইজের মস্তিষ্ক আমাদের। তবে ফুলকপির মতো অত শক্ত নয়, অত্যন্ত নরম। এর ভরের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ হলো পানি, বাকিটা চর্বি ও প্রোটিন। কী আশ্চর্যজনকভাবে মস্তিষ্ক আমাদের সব অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মস্তিষ্কের নিজের কোনো অনুভূতি নেই। মাথাব্যথা বলতে আমরা যা বুঝি, তা মস্তিষ্কের ভেতরের ব্যথা নয়।

মস্তিষ্ক শরীরের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অঙ্গ। অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার পরও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যাবলি যদি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

 মস্তিষ্ক তাই প্রাকৃতিকভাবেই খুবই সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে। চুল আর ত্বকের পরই আছে অত্যন্ত শক্ত মাথার খুলি। শরীরের সবচেয়ে শক্ত হাড়গুলোর একটি হলো মাথার খুলি। এটা আমাদের প্রাকৃতিক হেলমেট। মাথার খুলির নিচে আছে আরও তিনটি পাতলা স্তরের সুরক্ষাব্যবস্থামেনিঞ্জিস। মেনিঞ্জিসের নিচে আছে বিশেষ একধরনের তরলসেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড। এই তরল নরম মস্তিষ্ককে মাথার খুলির ভেতর নির্দিষ্ট জায়গায় ঠিকমতো বসিয়ে রাখে, শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ স্থাপন করে, রক্ত থেকে মস্তিষ্কের জন্য দরকারি পুষ্টি জোগায় এবং মস্তিষ্কের ভেতর কোনো বর্জ্য জমলে তা বের করে দেয়।আমাদের মস্তিষ্কের কাজকর্ম যেভাবে চলে, তাকে মোটামুটিভাবে একটি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সুপার কম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা কত বেশি, তা একটি ছোট্ট উদাহরণ থেকেই আন্দাজ করা যায়। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ৩০ বছর ধরে যত উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পেরেছে, মস্তিষ্ক ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এর চেয়ে অনেক বেশি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। মস্তিষ্কের উপরিভাগে পাতলা কর্টেক্স থাকে। এখানে ছোট একটি বালুকণার সমান আয়তনে প্রায় দুই হাজার টেরাবাইট তথ্য ধারণ করা সম্ভব। তার মানে, এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যে পরিমাণ ডিজিটাল ডেটা তৈরি হয়েছে, তার সবকিছুই মানুষের একটি মস্তিষ্কে ধরে যাবে।

মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের সঙ্গে তুলনা করা যায়। স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে যত তথ্য ও উপাত্ত মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তার প্রসেসিং চলে মস্তিষ্কে। প্রায় ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) নিউরন আছে সেখানে। এই নিউরনগুলো একে অপরের সঙ্গে এত বেশি জটিল সংযোগ তৈরি করেকাজ করে যে এই সংযোগের সংখ্যা প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন বা এক কোটি কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

নিউরনের এই সংযোগগুলোতে অত্যন্ত কম মাত্রায় জৈববিদ্যুৎ-প্রবাহ হয়। শরীরের জৈব যৌগের ইলেকট্রন ও আয়ন পর্যায়ের জটিল বিক্রিয়ায় এই তড়িৎপ্রবাহ তৈরি হয়। এর পরিমাণ অত্যন্ত কম (সর্বমোট মাত্র কয়েক মিলি-অ্যাম্পিয়ার)। মানুষের সারা শরীরের উৎপাদিত মোট বৈদ্যুতিক ক্ষমতা মাত্র ১০০ ওয়াটের মতো। কিন্তু এই ১০০ ওয়াটের মধ্যে ২০ ওয়াটই খরচ হয় মস্তিষ্কের কাজে।

মানুষের মস্তিষ্কের ভর শরীরের মোট ভরের মাত্র ২ শতাংশ, অথচ শরীরের মোট শক্তির ২০ শতাংশই তা খরচ করে ফেলে। শিশুদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। সদ্যোজাত শিশুরা শরীরের মোট শক্তির ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ খরচ করে মস্তিষ্কের কাজে। তাই তারা প্রায় সারাক্ষণই ঘুমাতে থাকে

মস্তিষ্কের নিউরনের সংযোগগুলোর প্রতিটি জৈব-বৈদ্যুতিক তরঙ্গপ্রবাহের স্পন্দনের স্থায়িত্ব মাত্র এক থেকে দুই মিলিসেকেন্ড, কিন্তু এদের গতি অনেক বেশি, ঘণ্টায় প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার।

 মস্তিষ্কের জৈব-বৈদ্যুতিক তরঙ্গ

 বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের জৈব-বৈদ্যুতিক তরঙ্গের প্রবাহ মাপার চেষ্টা করছিলেন অনেক বছর আগে থেকে। ১৮৭৫ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী রিচার্ড ক্যাটন খরগোশ ও বানরের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ মাপার চেষ্টা করেছিলেন গ্যালভানোমিটারের সাহায্যে। মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের লেখচিত্রইলেকট্রোএনসিফ্যালোগ্রাফি বা ইইজির উৎপত্তি হয়েছে তখন থেকেই। এনসিফেলন শব্দের অর্থ ব্রেন বা মস্তিষ্ক।

 মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক

 অত্যন্ত সংবেদী গ্যালভানোমিটার ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্কের প্রথম ইইজি করেন জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী হ্যানস বার্গার, ১৯২৪ সালে। তিনিই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন যে মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক, জাগ্রত অবস্থার তরঙ্গের কম্পাঙ্কের চেয়ে ভিন্ন। এরপর মানুষের বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্কের কী ধরনের পরিবর্তন হয়, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্নায়ুবিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানীরা।কম্পাঙ্ক অনুসারে মস্তিষ্কের তরঙ্গকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। আমরা যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করতে থাকি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক অনেক বেড়ে যায়। কম্পাঙ্ক ৩৫ হার্জের বেশি হলে তাদের বলা হয় গামা তরঙ্গ। গামা তরঙ্গ হলো মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ক্ষমতার নির্দেশক। এই সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে অনেক ধরনের তরঙ্গের আদান-প্রদান ঘটে। যখন আমরা স্বাভাবিক কাজে ব্যস্ত থাকি, তখন মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক থাকে ১২ থেকে ৩৫ হার্জের মধ্যে। এই কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে বলা হয় বেটা তরঙ্গ ।   

 বেটা তরঙ্গ।

আমরা যখন কথাবার্তা বলি, কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই, সমস্যার সমাধান করি, লেখাপড়া শিখি, তখন মস্তিষ্কে দেখা যায় বেটা তরঙ্গ।

 মস্তিষ্কের তরঙ্গকে পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হলেও প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ কিন্তু স্বতন্ত্র। এখানেই মানুষের সঙ্গে রোবটের পার্থক্য। মানুষের মৌলিক শারীরিক গঠন একই রকম হলেও প্রত্যেক মানুষ আলাদা।বিশ্রামের সময় মস্তিষ্কের কম্পাঙ্ক আরও কমে যায়। তখন কম্পাঙ্ক থাকে ৮ থেকে ১২ হার্জের মধ্যে। এই তরঙ্গগুলোকে আলফা তরঙ্গ বলা হয়। মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক আরও কমে গেলে আমাদের তন্দ্রা আসে।

 থেটা তরঙ্গ

 মস্তিষ্কের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ৪ থেকে ৮ হার্জের মধ্যে হলে তাদের থেটা তরঙ্গ বলা হয়। আমাদের দৈনন্দিন কাজ যেগুলো আমরা অভ্যাসবশত করি, যেমন দাঁত ব্রাশ করা, গোসল করা, নিজের ঘরের মধ্যে হাঁটা ইত্যাদির সময় আমাদের মস্তিষ্ক থেটা তরঙ্গে কাজ করে।

  লটা তরঙ্গ

 আর সবচেয়ে কম কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে বলা হয় ডেলটা তরঙ্গ। ডেলটা তরঙ্গের কম্পাঙ্ক শূন্য দশমিক ৫ থেকে ৪ হার্জ। এই তরঙ্গে আমাদের মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের সারা দিনের ক্লান্তি দূর করারজন্য মস্তিষ্কের এই বিশ্রাম দরকার হয়। ডেলটা তরঙ্গ হলো মস্তিষ্কের বিশ্রামের তরঙ্গ।

 স্নায়ুর চিকিৎসায় ইইজি প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৩৭ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে। তারপর থেকে ইইজি সিস্টেমের অনেক উন্নতি হয়েছে। কম্পিউটার টেকনোলজি ও ইলেকট্রনিকের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ইইজির ব্যবহারিক ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। মস্তিষ্কের অনেক জটিল রোগ নির্ণয়ে এবং অন্যান্য চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণে এই ইইজির সাহায্যে মস্তিষ্কের তরঙ্গের পরিবর্তনের দিকে লক্ষ রাখা হয়। রোগী যদি কোমায় চলে যায়, তখন রোগীর মস্তিষ্কের কাজকর্মের কোনো উন্নতি হচ্ছে কি না, দেখা হয় মস্তিষ্কের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে।

 মাথায় আঘাত পেলে কিংবা স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কের তরঙ্গের পরিবর্তন হতে পারে। অনিদ্রা, মৃগীরোগসহ অন্যান্য স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় ভূমিকা রাখছে মস্তিষ্কের তরঙ্গের বিন্যাস।মস্তিষ্কের তরঙ্গকে পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হলেও প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ কিন্তু স্বতন্ত্র। এখানেই মানুষের সঙ্গে রোবটের পার্থক্য। মানুষের মৌলিক শারীরিক গঠন একই রকম হলেও প্রত্যেক মানুষ আলাদা। তাদের চিন্তার ধরন আলাদা, একই ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারটা মস্তিষ্কের তরঙ্গের মাধ্যমে আলাদা করা যায়, কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। এখানেই মস্তিষ্কের বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

 

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া


Comments

Popular posts from this blog

Ashraful Ambia Muhammadur Rasulullah Sallallahu A'laihi Wasallam: in the eyes of prominent Non-Muslim scholars

The Alhambra in Granada, Spain

প্রত্যেক বিষয় মূলে পৌছে (ফারাবী আল আরাবী)।